top of page
            সম্যক দৃষ্টি কাকে বলে ?

অর্ণব ব্যানার্জিঃ বুদ্ধের বিশুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের মধ্যে প্রথমে সম্যক দৃষ্টির কথা শোনা যায়| কিন্তু এটি কি? এই প্রসঙ্গে খুব কমই জানা যায়| এই লেখায় আমি বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্র থেকে খুঁজে দেখব যে বুদ্ধ সম্যক দৃষ্টি সম্বন্ধে ঠিক কি বলেছিলেন|

 

প্রথমে দেখা যাক ধম্মপদে বুদ্ধ কি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন. ধম্মপদের ধম্মট্থ বর্গে বুদ্ধ বলেছিলেন:

 

২৫৬] ন তেন হতি ধম্মট্থ যেনত্থং সহসা নয়ে

 

     জো চ অত্থং অনত্থং চ উভো নিচ্ছেজ্য পন্ডিত

 

২৫৭] অসাহসেন ধম্মেন সমেন নয়তি পরে

 

   ধম্মস্য গুত্ত মেধাবী ধম্মট্থ তি পবুচ্চতি

 

অর্থাত যিনি হঠকারিতার সাথে কোনো বিষয় বিচার করেন তিনি ধর্মস্থ নন| যে পন্ডিত ব্যক্তি অর্থ অনর্থ উভয়েই বিচার করেন, বল প্রয়োগের আশ্রয় না নিয়ে ধর্ম ও ন্যায় দ্বারা অপরকে চালিত করেন তিনিই ধর্মস্থ|

 

অর্থাত বুদ্ধ কোনো হঠকারী ব্যক্তিকে ধর্মস্থ বলেননি| তিনি চিন্তাশীল ব্যক্তিকে ধর্মস্থ বলেছেন|অর্থাত চিন্তাশীল দূরদর্শী অর্থ ও অনর্থ বিচারকারী ব্যক্তিই ধর্ম করে| চিন্তা হলো মনের দর্শন্ শক্তি| অর্থ ও অনর্থ চিন্তা অর্থাত সবদিক উত্তমরূপে বিবেচনা করাই হলো সম্যক দর্শন করা|

 

বিবেচনাটি কেমনভাবে করতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ধম্মপদের ধম্মট্থ বর্গে বলা আছে যে কোনো বস্তুর বাইরের লক্ষণ দেখে তার প্রকৃত চরিত্র জানা যায় না| বস্তুর অন্তরের লক্ষণ দেখেই তার প্রকৃত চরিত্র জানা যায়| ওই বর্গে বিভিন্ন উপদেশের মাধ্যমে এই বলা আছে , যেমন:

 

১] মুন্ডিত মস্তক হলেই কেউ শ্রমণ হয় না|

 

২] পাকা চুল থাকলেই কেউ থের হয় না|

 

৩] বাচালতা অর্থাত অনেক বকবক করলেই কেউ পন্ডিত হয় না|

 

৪] ভিক্ষে করলেই কেউ ভিক্ষু হয় না| ইত্যাদি

 

ধম্মপদের যমক বর্গে আছে :

 

১১] অসারে সারমতিনো সারে চাসারদসসিনও

 

   তে সারং নাধিগচ্ছন্তি মিচ্ছাসংকপ্পগোচরা

 

অর্থাত যারা মিথ্যা সংকল্প অনুসারী হয়ে অসারকে সার জ্ঞান করে এবং সারকে অসার জ্ঞান করে , তারা সার বস্তুতে উপনীত হয় না|

 

১২] সারং চ সারত ঞ্ত্বা অসারং চ অসারত

 

   তে সারং অধিগচ্ছন্তি সম্মাসংকপ্পগোচরা

 

অর্থাত যারা সারকে সার এবং অসারকে অসার জ্ঞান করে, সত্য সংকল্প অনুসারী তারা সারকে পায়|

 

বুদ্ধ বলেছেন যে , যে বস্তু যাহা তাকে তাহা জানাই উচিত| ইহাই সম্যক দর্শন| ইহাই প্রকৃত দর্শন|

 

এছাড়া সুত্তপিটকের অন্তর্গত কালামা সুত্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে| কালাম নগরের বাসিন্দাদের বুদ্ধ বলেছিলেন যে, কোনো তর্কে বা শাস্ত্রে বা কুটযুক্তিতে বা কোনো ধর্মগুরুর কথায় বিশ্বাস করবে না| নিজে যা উপলব্ধি করবে শুধু তাতেই বিশ্বাস করবে| এটা সরাসরি অভিজ্ঞতাবাদ বা প্রত্যক্ষবাদের মত কথা হলো| শুধু নিজের অভিজ্ঞতার উপর বিশ্বাস করার নামই হলো প্রকৃত দর্শন| এই কথার আজ অতি প্রয়োজন| চারদিকে যেসব ঠগ জোচ্চর ধর্মগুরু বেরিয়েছে তাতে নিজের অভিজ্ঞতাই একমাত্র তোমাকে বাচাতে পারে| এদের কথা শুনলে নিজের সর্বনাশ হয়ে যাবে| এনিয়ে আরেকটা লেখায় বিস্তারিত লিখব|

 

এই একই কথার সমর্থন আমরা পাই T W R Davids এর বই “ডায়ালগস অফ দা বুদ্ধা” –এর তিন নম্বর ভলুমের ৮৭ পাতায় একটা কথোপকথনে| বুদ্ধ আর সারিপুত্তের মধ্যে বার্তালাপ হচ্ছিল|

 

সারিপুত্ত বললেন : “ প্রভু অতীতে, বর্তমানে, ভবিষ্যতে এমন কোনো জ্ঞানী জন্মান নি বা জন্মাবেন না যিনি আপনার চাইতেও জ্ঞানী|” বুদ্ধ শুনে স্মিতহাস্যে বললেন, “ সারিপুত্ত তুমি নিশ্চই অতীতের যত মহাজ্ঞানী ছিলেন তাদের জেনেছ এবং তাদের জ্ঞানের সারমর্ম অনুধাবন করেছ|” সারিপুত্ত বললেন, “ না প্রভু|”

 

“ তাহলে তুমি নিশ্চই ভবিষ্যতের সব মহাজ্ঞানীদের জেনেছ এবং তাদের জ্ঞানকে তোমার মন দিয়ে গ্রহণ করেছ|”

 

“না প্রভু|”

 

“তাহলে অন্তত আমি যেটুকু জেনেছি তার সবটাই জেনেছ|”

 

“না প্রভু তাও পারিনি|”

 

“তবেই দেখ সারিপুত্ত, তুমি অতীতের এবং বর্তমানের জ্ঞানীদের কথা জান না, তাহলে তুমি কেন এই সোত্সাহ সংকির্তনে প্রবৃত্ত হয়েছ?

 

এছাড়াও ওই একই বইয়ের ১৫৩ নম্বর পাতায় আছে, মৃত্যুর পূর্বে বুদ্ধ তার প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বলেন: “যারা নিজেদের কাছে নিজেরাই প্রদীপ হয়ে উঠবে, বাইরের কোনো কিছুর উপর নির্ভর না করে নিজের নিজের দীপশিখার আলোকেই নিজেদের জীবন পরিচালিত করবে, আমার জীবদ্দশায় বা কি, আমার মৃত্যুর পরেই বা কি,তারাই তো চরম শিখরে উঠবে|”

 

অর্থাত বুদ্ধ বলতে চেয়েছিলেন যে, তুমি নিজে জানো|বাইরের কোনো কিছুর ওপর ভরসা কর না|নিজে জানা আর লোকের উপরে বিশ্বাস করার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান| অন্যের ওপর বিশ্বাস করে লোকে প্রতারিত হয়| আগেও হয়েছে, এখন তো আরো বেশি হয়|বুদ্ধ কথিত সম্যক দৃষ্টির অর্থ হলো নিজে জানা বা স্বঅনুভুতি, পরের মুখে ঝাল খাওয়া নয়|

 

হঠকারিতার সাথে বিচার না করা, বিষয়ের ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিচার করা, বাইরের চাকচিক্যে না ভোলা, যেটা যেমন তাকে তেমন জানা এবং সর্বোপরি নিজে জানা বা স্বঅনুভুতি : এই হলো বুদ্ধের সম্যক দর্শনের অর্থ. এটাই অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথম মার্গ| এটাই হলো শুরু| কারণ বাকি সাতটা মার্গ শুধু এই এক সম্যক দর্শনের ওপর নির্ভরশীল|

 

প্রশ্ন হতে পারে যে বাইরের সাহায্য ছাড়া কিভাবে কোনো কিছু জানা যায় ? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাইরের বস্তু গ্রহণ করি এবং তখন জানি| তাহলে বুদ্ধ কিকরে কালামদের এবং নিজের শিষ্য আনন্দকে বলছেন যে, বাইরের উপর নির্ভর না করে নিজের আলোকে নিজেই জানবে? এটি কিভাবে সম্ভব? এর উত্তরে বলা যায় যে বাইরের উপর নির্ভর করা বলতে বুদ্ধ বুঝাতে চেয়েছেন যে, বাইরের জ্ঞানের উত্স যেমন কোনো ব্যক্তি, শাস্ত্র, তর্ক ইত্যাদিকে বিশ্বাস করে জানা| অন্যভাবে বলা যায় যে এই বাইরের জ্ঞানের উত্সের ওপর অধিক বিশ্বাস| বা বলা যেতে পারে অন্ধবিশ্বাস| যা আজকাল অত্যন্ত বেশিমাত্রায় দেখা যায়|এতে ভীষণ ক্ষতি হয়| আজকের যারা ধর্মধ্বজি মুসলমান বা হিন্দু , তারা প্রত্যেকেই অন্ধবিশ্বাসী| তারা আইসিস, আলকায়দা ইত্যাদির জন্ম দিয়েছে| পক্ষান্তরে নিজে উপলব্ধি করা বা অনুভব করা অনেক শ্রেয়|এতে সত্যিকারের তত্ত্ব লাভ হয়| প্রত্যেক ধর্মগুরুরা নিজে উপলব্ধি করেছে| লালন ফকির, বুদ্ধ, খ্রিষ্ট, কৃষ্ণ, চৈতন্যদেব : প্রত্যেকের নিজ উপলব্ধিই ধর্ম হয়ে গেছে| তবে ওদের উপলব্ধি বা অনুভুতি হলেই সবার হবে না| প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজেকে প্রয়াস করতে হবে| তবেই উপলব্ধি হবে| এবিষয়ে বুদ্ধ বলেছেন :

 

২৭৬] তুহমেহী কিচ্চং আতপ্পং অকখাতারো তথাগতা

 

     পটিপন্না পমোকখন্তি ঝায়িনো মারবন্ধনা (মগ্গ বগ্গ, ধম্মপদ )

 

অর্থাত প্রয়াস তোমাদিগকেই করিতে হইবে, তথাগতগণ প্রচারকমাত্র|মার্গাবলম্বী ধ্যায়ী মারবন্ধন হইতে মুক্ত হন|

 

সুতরাং যতই ধর্মগুরুরা জানুক না কেন তাতে নিজেদের লাভ হবে না| তারা জানলেই তুমি জানবেনা| তুমি ততকাল অন্ধ থাকবে যতকাল তুমি নিজে জানার চেষ্টা না কর| এইজন্যই বুদ্ধ কালামা ও আনন্দকে বলেছেন যে নিজেই নিজের দীপ হও, অন্যের উপর নির্ভর না করে নিজে জানো বা অনুভব কর| সারিপুত্তকেও বুদ্ধ একই কথা বলেছেন|

 

এই নিজে উপলব্ধি কিভাবে হতে পারে? কেবল ধ্যানের দ্বারা| ধ্যান মানে গভীর ভাবে চিন্তন এবং মনন| অর্থাত গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে নিজস্ব উপলব্ধি বা অনুভুতি হয় কোনো বিষয়ে| এটাতো আমাদের প্রাত্যহিক উপলব্ধি| তবে বিষয় ভিন্ন ভিন্ন| বুদ্ধ নির্বানের বিষয়ে চিন্তা করতে বলেন| আর আমরা তুচ্ছ জাগতিক বিষয়ে চিন্তা করি| পার্থক্য শুধু এইটুকুমাত্র|

 

ধম্মপদে বুদ্ধ ধ্যানের ব্যাপারে বলেছেন:

 

২৮২] যোগা বে জায়তি ভুরি অযোগা ভুরিসংখযো

 

   এতং দ্বেধাপথং ঞ্ত্বা ভবায় বিভবায় চ

 

   তথত্তানং নিবেসেস্য যথা ভুরি পবডঢতি

 

                   (মগ্গ বগ্গ , ধম্মপদ )

 

অর্থাত ধ্যান হইতে জ্ঞানের উদ্ভব হয়, ধ্যানের অভাবে জ্ঞান ক্ষয়প্রাপ্ত হয়| লাভ ও ক্ষতির এই দুই পথ জেনে নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত করবে যাতে জ্ঞান বাড়ে|

 

বুদ্ধ তার শেষ জীবনে ধ্যানের বিষয়ে বহু উপদেশ দিয়ে গেছেন| সেইসব উপদেশ নিয়ে এক নতুন ধর্ম জেন্ উত্পন্ন হয়েছে যার শুরু এবং শেষ কথা হলো ধ্যান| ধ্যান সম্যক দৃষ্টি আনে| ধ্যানই সম্যক দৃষ্টির একমাত্র উত্স| ধ্যানচক্ষে দর্শনই সম্যক দর্শন|

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

 

ধম্মপদ(পালি-বাংলা) , অনুবাদক ভিক্ষু শীলভদ্র

 

লেখকঃ অর্ণব ব্যানার্জি। পেশায় একজন আইজীবি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

 

 

 

© 2023 by the Barua Buddhist News/Media 

bottom of page